গিটারের নীল সুর
Written By: শেষ সন্ধ্যার কবি
সন্ধা ৬টারাস্তার ল্যাম্প পোষ্টের আলো গুলো প্রায় নিভু নিভু হয়ে জ্বলছে। রিহান একটা ল্যাম্প পোষ্টের গায়ে হেলান দিয়ে গিটার নিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সিগারেট টানছে আর ব্যাস্ত যানবাহন গুলোর বেস্ততা দেখছে।
সিগারেট টা শেষ হয়ে এলো প্রায়। লাস্ট টানটা জোরে টেনে হাতের ২ আঙ্গুল দিয়ে চেপে ধরে সিগারেট টা নিভিয়ে টোকা দিয়ে দূরে নিক্ষেপ করলো।
অন্ধকার হয়ে এসেছে। গিটারটা কাঁধে নিয়ে রেল লাইনের দিকে হাটতে লাগলো।
কিছুক্ষন পর রেল লাইনের কাছে এসে দাঁড়ালো। ট্রেন যাচ্ছে। ভার্সিটির ট্রেন। এখন অবশ্য ছাত্র ছাত্রীরা নেই। কিছু কর্ম মুখী মানুষ কাজ শেষে বাসায় যাচ্ছে।
ট্রেন টা চলে যাওয়ার পর সে রেল লাইনের মাঝখান দিয়ে হাট তে লাগলো। হাট তে হাট তে বেশ কিছুদূর যেয়ে দেখে, ৫ টা ছোট ছেলে, গায় ময়লা জামা, খালি পা রেল বিটের উপর বসে তন্দুর রুটি ভাগ করে খাচ্ছে।
রিহান তাদের পাশে বসে পড়লো। তারো খুব খেতে ইচ্ছা করছে তাদের খাওয়া দেখে। সেও সকালে ১টা রুটি ছাড়া কিছু খাইনি। তাই হয়তো খিদেটা জানান দিয়েছে।
রিহান খুব মনযোগ দিয়ে তাদের খাওয়া দেখছে। রিহান যে এভাবে তাদের দিকে তাকিয়ে আছে, সেটা তাদের মধ্যে থাকা একটা ছেলে খেয়াল করলো, ছেলেটা তার আধ খাওয়া রুটি থেকে অর্ধেক ছিঁড়ে দিয়ে বললো, ভাইজান খান। আপনে মনে হয় কিছু খান নাই।
রিহান খুব আগ্রহ নিয়ে রুটিটা নিলো। নিয়েই ২ গ্রাসে শেষ করে ফেললো। একটা ছেলে বললো, খাড়ান আমি পানি নিয়া আইতাসি। এটা বলে সে এক দৌড়ে একটা বোতলে করে পানি নিয়ে আসলো।
রিহান ঢক্ ঢক্ করে পানি খাচ্ছে, আর তার পানি খাওয়াটা সবাই মনযোগ দিয়ে দেখছে। পানি খাওয়া শেষ হলে একটা ছেলে বললো,,
>> ভাইজান কি গান করেন? হুনাইবেন আমাগোরে?
>> হুম শোনাবো। আচ্ছা, কি নাম তোমাদের? কোথায় থাকো তোমরা? কি করো?
>> তাদের মধ্যে একজন বললো, আমি সজিব, আর ওরা আমার বন্ধু, রাসেল, ফাহিম, মিনার, আজগর। আমি পেপার বিক্রি করি। ওরা কাগজ টোকায়। আমরা এইহানেই থাহি। আমাগো কেউরি বাপ মা নাই।
>> রিহান বেশ অবাক হল। তাদের সবার বয়স বেশি হলে ৯/১০. নিজেরা ইনকাম করে নিজেরাই খাচ্ছে। তাও পেট পুরে খেতে পারেনা। রোদ, বৃস্টি, শীতে কতো কষ্ট পাচ্ছে তারা।
>> কি ভাবতেছেন ভাইজান?
>> না কিছুনা। আচ্ছা সজিব, আজ রাতে তোমরা কি খাবে?
>> ক্যান ভাইজান, এহন খাইলাম না? আবার সকালে পেপার বেইচা একলগে খামু।
রিহান এর পকেটে ৫০০ টাকা আছে। রিহান কে টাকাটা তার মা দিয়েছে বাজার করার জন্য।
>>সে সজিব কে টাকাটা দিয়ে বললো এটা রাখো সজিব, তোমরা এটা দিয়ে কিছু কিনে খেও।
>> না ভাইজান, আমরা ভিক্ষা নেইনা। না খায়া মরুম। কিন্তু ভিক্ষা নিমুনা।
রিহান কি বলবে ভেবে পেলনা। টাকাটা মানিবেগে রেখে দিলো।
>> ভাইজান গান হুনাইবেন কখন?
রিহান কি জেনো ভাবল। তারপর ওদের বললো। হে হে অবশ্যই শোনাবো। তোমরা এখান থেকে যাবেনা। আমি ১ঘন্টার মধ্যেই আবার আসবো। কেউ যাবেনা কিন্তু। এটা বলতে বলতে রিহান কাঁধে গিটারটা নিয়ে চলে গেলো।
১ঘন্টা পর
৫জনের হাতে ৫টা বিরানীর প্যাকেট।
>> আমি তোদের ভিক্ষা দেইনিরে। টাকাটা তোদের এমনি দিয়েছিলাম। কিন্তু তোরা তা নিলিনা। তাই এখন তোদের জন্য বিরানী নিয়ে আসলাম। এটাতো আর ভিক্ষা না। আল্লাহ্ আজ না হয় তোদের এই বড় ভাই এর উছিলায় খাওয়াচ্ছে। কেন, তোদের থেকে কি আল্লাহ্ আমাকে খাওয়ায়নি?
তারা ৫জনেই রিহান কে জড়িয়ে ধরলো।
>> ভাইজান আপনে অনেক ভালা মানুষ। আল্লাহ্ আপনেরে অনেকদিন বাঁচায়া রাখুক। আপনের মতো কেউই আমাগোরে এমন কইরা খাওয়ায় নাই।
রিহান কি বলবে ভেবে পাচ্ছেনা। কথা ঘুরিয়ে বললো,,
>> তোরা খেয়ে নে তাড়াতাড়ি, তারপর তোদের গান শোনাবো।
তারা প্যাকেট খুলে খেতে শুরু করলো, সজিব বললো,,
>>ভাইজান আপনে খাবেন না?
>> নারে আমার খিদে নেই।
সজিব জোর করে তার প্যাকেট থেকে এক লোকমা তুলে রিহান কে খাইয়ে দিলো। সজিবের দেখা দেখি বাকিরাও রিহান কে এক লোকমা করে খাইয়ে দিলো।
রিহান নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলোনা।
>> তোরা খা, গিটারটা এখানে থাক। আমি আসছি। এটা বলে রিহান একটু দূরে সরে ওদের আড়াল হয়ে দাঁড়ালো।
একটা সিগারেট ধরিয়ে তাদের খাওয়া দেখতে লাগলো। আর তার দুই চোখ বেয়ে পানি ঝরতে লাগলো।
কিছুক্ষন পর রিহান চোখ মুছে এসে বললো,,
>> খাওয়া শেষ?
>> হ ভাইজান শেষ। এইবার গান হুনান। তারা সবাই রিহান কে ঘিরে বসল।
রিহান তার গিটারটা বাজাতে লাগলো। গিটার থেকে একটা করুণ সুর বের হতে লাগলো। একেই হয়তো নীল সুর বলে। রিহান চোখ বন্ধ করে গিটারের সুরে সুরে গাইতে লাগলো....
চিঠি পৌছে যাবে পৃথিবীর প্রান্তে
চিঠি পৌছে যাবে রঙ্গিন খামে
চিঠি পৌছে যাবে মিছিলে মিছিলে
আসছে খবর হবে ক্ষিদের অবসান।
দুঃখ দারিদ্রের চিরো ঠিকানায়
চলে যাক চিঠি সবুজ ভরসায়।
চিঠি পৌছে যাবে।
রিহান চোখ খুলে তাদের দিকে তাকিয়ে দেখলো তারা একজনের গায়ে আরেকজন ঢলে পরে ঘুমাচ্ছে। রিহান মুচকি একটা হাসি দিয়ে আসতে করে উঠে একটা সিগারেট ধরাল। তারপর গিটারটা কাধে নিয়ে বাসার দিকে হাট তে লাগলো, আর সিগারেট টানতে টানতে বাকী গানটা গাইতে লাগলো.....
একটা চিঠির যার বিবরণ ছিলো
লক্ষ শিশুর ইতিহাস
শিশুর দু চোখ কান্নায় লেখা ছিলো
ক্ষিদে মুক্তির বসবাস...
রিহান পিছনে ফিরে তাদের দিকে আরেকবার তাকিয়ে থাকলো, হঠাৎ আনমনে তার দু চোখ বেয়ে পানি ঝরতে লাগলো.....
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন